সমাস কাকে বলে? সমাস কত প্রকার ও কি কি? – সমাসে বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিচে সমাসের বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ উদাহরণস্বরূপ বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সব PDF গুলি একসঙ্গে ডাউনলোড করতে আমাদের Telegram চ্যানেলে যুক্ত হন।
সূচিপত্র
সমাস কাকে বলে?
বাংলা ভাষায় শব্দ গঠনের একটি বিশিষ্ঠ প্রক্রিয়া হল সমাস। অর্থসম্মন্ধে যুক্ত দুটি বা তার বেশি শব্দকে জুড়ে নতুন একটি শব্দ গঠন করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় সমাস। যেমনঃ ভালো ও মন্দ = ভালোমন্দ, চোরা যে বালি = চোরাবালি, হাত দ্বারা ছানি = হাতছানি, দশ ভুজ যার = দশভুজা, নব গ্রহের সমাহার = নবগ্রহ, ঘরে ঘরে = প্রতিঘর, দুধে ও ভাতে = দুধেভাতে ইত্যাদি।
সমাস শব্দের অর্থ কি?
সমাস শব্দের অর্থ হল – অর্থগতভাবে পারস্পরিক সম্বন্ধযুক্ত একাধিক পদের একপদীকরণ। সমাস হল দুই বা ততধিক শব্দের আঠগত মিলন। সমাস শব্দটির সাধারণ অর্থ হল – সংক্ষেপ।
সমস্যমান পদ কাকে বলে?
যেসব পদের দ্বারা সমাস গঠিত হয়, তাদের প্রত্যেকটিকে বলা হয় সমস্যমান পদ। যেমনঃ জন্ম ও মৃত্যু = জন্মমৃত্যু। এই উদাহরনটিতে ‘জন্ম’ এবং ‘মৃত্যু’ —এই দুটি হল সমস্যমান পদ।
যে-কোন সমাসে দুটি সমস্যমান পদ থাকে — পূর্বপদ এবং পরপদ বা উত্তরপদ। যে দুটি পদের দ্বারা সমাস সঙ্ঘটিত হয়, তার প্রথমটিকে পূর্বপদ এবং পরবর্তীটিকে বলা হয় পরপদ বা উত্তরপদ। যেমনঃ জন্ম ও মৃত্যু = জন্মমৃত্যু। এই উদাহরনটিতে ‘জন্ম’ হল পূর্বপদ এবং ‘মৃত্যু’ পরপদ।
সমস্তপদ বা সমাসবদ্ধ পদ কাকে বলে?
সমস্যমান পদ বা পূর্বপদ এবং পরপদ দুটির মিলনে যে নতুন পদটি গঠিত হয়, তাকেই সমস্তপদ বা সমাসবদ্ধ পদ। যেমন — জন্ম ও মৃত্যু = জন্মমৃত্যু। এই উদাহরনটিতে ‘জন্ম’ এবং ‘মৃত্যু’ —এই দুটি হল সমস্যমান পদের মিলনে গঠিত “জন্মমৃত্যু” হল সমস্তপদ বা সমাসবদ্ধ পদ।
ব্যাসবাক্য বা সমাসবাক্য পদ কাকে বলে?
সমস্তপদটির গঠনগত অর্থ বিশ্লেষণের জন্য যে বাক্যাংশের প্রয়োগ করা হয়, তাকেই ব্যাসবাক্য বা সমাসবাক্য বলে। যেমন — জম্মমৃত্যু – এই সমাসবদ্ধ পদটির অর্থ বোঝার জন্য পূর্ব ও পর পদের সাহায্যে একটি বাক্যংশ তৈরি করতে হয়। যেমন – জন্ম ও মৃত্যু। এক্ষেত্রে জন্ম ও মৃত্যু হল ব্যাসবাক্য বা সমাসবাক্য।
সমাস কত প্রকার কি কি
বর্তমান পাঠ্যক্রমে বাংলা সমাসকে মোট 9 টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। হলঃ
- দ্বন্দ্ব সমাস
- কর্মধারায় সমাস
- তৎপুরুষ সমাস
- বহুব্রীহি সমাস
- দ্বিগু সমাস
- অব্যয়ীভাব সমাস
- নিত্য সমাস
- অলোপ সমাস
- বাক্যাশ্রয়ী সমাস
1. দ্বন্দ্ব সমাস কাকে বলে?
যে সমাসের সমস্যমান পদদুটি কোনো সংযোজক অব্যয় দ্বারা যুক্ত এবং যেখানে সমস্যমান দুটি পদেরই অর্থ সমানভাবে প্রাধান্য পায়, তাকে বলা হয় দ্বন্দ্ব সমাস। যেমনঃ ধনী ও গরিব = ধনীগরীব। এই সমাসে ‘ধনী‘ পূর্বপদ এবং ‘গরিব‘ পরপদ। এখানে সমস্যমান পদ দুটি সংযোজক অব্যয় ‘ও’ দ্বারা যুক্ত হয়ে সমাস বদ্ধহয়েছে।
দ্বন্দ্ব সমাসের উদাহরণঃ
ব্যাসবাক্য | সমাসবদ্ধ পদ |
---|---|
ভাই ও বোন | ভাইবোন |
কাঁচা ও পাকা | কাঁচাপাকা |
তুমি আর আমি | তুমিআমি |
বাড়ি ও ঘর | বাড়িঘর |
স্বর্গ ও নরক | স্বর্গনরক |
2. কর্মধারায় সমাস কাকে বলে?
যে সমাসের সমস্যমান পদ দুটির মধ্যে যখন একটি বিশেষ্য এবং অন্যটি বিশেষণ কিংবা উভয় পদই বিশেষ্য অথবা বিশেষণ হয় এবং পরপদটির অর্থ প্রাধান্য পায়, তখন তাকে বলা হয় কর্মধারায় সমাস। যেমন – বিশ্ব যে মানব -= বিশ্বমানব। এই উদাহরনটিতে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পেয়েছে।
কর্মধারায় সমাসের উদাহরণঃ
ব্যাসবাক্য | সমাসবদ্ধ পদ |
---|---|
পূর্ণ যে চন্দ্র | পূর্ণচন্দ্র |
যিনি রাজা তিনিই ঋষি | রাজর্ষি |
ঘরে আশ্রিত জামাই | ঘর জামাই |
মন রূপ মাঝি | মনমাঝি |
আয়ের উপর কর | আয়কর |
3. তৎপুরুষ সমাস কাকে বলে?
যে সমাসের পূর্বপদে থাকা কারক ও অ-কারক বিভক্তি বা অনুসর্গ সমস্ত পদে বা সমাসবদ্ধ পদে লোপ পায় এবং সেইসঙ্গে পরপদটির অর্থটি প্রধান হয়ে ওঠে, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমনঃ কলাকে বেচা = কলাবেচা। সমাসের এই উদাহরনটিতে পূর্বপদের ‘কে’ বিভক্তি লোপ পেয়েছে এবং পরপদ ‘বেচা’ -এর অর্থটিই প্রাধান্য পেয়েছে।
তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণঃ
ব্যাসবাক্য | সমাসবদ্ধ পদ |
---|---|
বিয়ের জন্য পাগলা | বিয়েপাগলা |
অগ্নি থেকে ভয় | অগ্নিভয় |
গ্রামে বাস করে যে | গ্রামবাসী |
ছাত্রদের জন্য আবাস | ছাত্রাবাস |
ঢেঁকি দ্বারা ছাটা | ঢেঁকিছাটা |
4. বহুব্রীহি সমাস কাকে বলে?
যে সমাসে সমস্যমান পদ দুটির অর্থ প্রধানরূপে প্রকাশিত না হয়ে অন্য্ কোনো অতিরিক্ত অর্থ প্রকাশিত হয়, তাকে বলা হয় বহুব্রীহি সমাস। যেমনঃ পঞ্চ আনন যার = পঞ্চানন। এই সমাসে ‘পঞ্চ’ ও ‘আনন’ -এই সমস্যমান পদ দুটির অর্থ প্রাধান্য না পেয়ে অতিরিক্ত অর্থ – পঞ্চানন প্রাধান্য পেয়েছে।
বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণঃ
ব্যাসবাক্য | সমাসবদ্ধ পদ |
---|---|
চক্র পানিতে যার | চক্রপাণি |
দশ ভুজ যার | দশভুজা |
বীনা পানিতে যার | বীণাপানি |
কোলে কোলে যে আলিঙ্গন | কোলাকুলি |
নেই অপরাধ যার | নিরপরাধ |
5. দ্বিগু সমাস কাকে বলে?
সংখ্যাবাচক বিশেষণ পদের সঙ্গে বিশেষ্য পদের সমাস হলে এবং তাতে সমাহার বা সমষ্টি অর্থ প্রকাশ পেলে তাকে দ্বিগু সমাস বলা হয়। যেমনঃ সপ্ত ঋষির সমাহার। এই উদাহরনে পূর্বপদ ‘সপ্ত’ সংখ্যাবাচক বিশেষণ, উত্তরপদ ‘ঋষি’ হল বিশেষ্য এবং ব্যাসবাক্য ‘সমাহার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
দ্বিগু সমাসের উদাহরণঃ
ব্যাসবাক্য | সমাসবদ্ধ পদ |
---|---|
ত্রি ফলের সমাহার | ত্রিফলা |
নব রত্নের সমাহার | নবরত্ন |
নব গ্রহের সমাহার | নবগ্রহ |
দো চালের সমাহার | দোচালা |
পাঁচ কড়ির সমষ্টি | পাঁচকড়ি |
6. অব্যয়ীভাব সমাস কাকে বলে?
যে সমাসের পূর্বপদে থাকা অনব্যয় পদটি সমাস নিষ্পন্ন হবার পর অব্যয়ের ভাবধারন করে এবং সমাসবদ্ধ পদটিতে পূর্বপদের অর্থটিই প্রধান হয়ে উঠে, তাকেই বলে অব্যয়ীভাব সমাস। যেমনঃ জন্ম হতে = আজন্ম। এই উদাহনটিতে পূর্বপদ ‘জন্ম’ কোন অব্যয় পদ নয় কিন্তু ‘আ’ অব্যয় যুক্ত হয়ে একটি সমাসবদ্ধ হবার পর একটি অব্যয়ের ভাব সৃষ্টি হয়েছে।
অব্যয়ীভাব সমাসের উদাহরণঃ
ব্যাসবাক্য | সমাসবদ্ধ পদ |
---|---|
কৈশোর থেকে | আকৈশোর |
বাল হতে | আবাল্য |
আদি হতে অন্ত | আদ্যন্ত |
দানের বিপরীত | প্রতিদান |
নদীর সদৃশ্য | উপনদী |
7. নিত্য সমাস কাকে বলে?
যে সমাসে প্রকৃতপক্ষে ব্যাসবাক্য হয় না, ব্যাসবাক্য করতে চাইলে অন্য্ পদের সাহায্যে সমস্তপদের অর্থ প্রকাশ করতে হয়, তাকেই নিত্য সমাস বলে। যেমনঃ দেশ + অন্তর = দেশান্তর। সন্ধিবদ্ধ এই উদাহরনটিতে ব্যাসবাক্য ও সমাসবদ্ধ পদ একই। ব্যাসবাক্যটিতে সর্বদা সমাসবদ্ধ থাকে বলে একে নিত্য সমাস বলে।
নিত্য সমাসের উদাহরণঃ
ব্যাসবাক্য | সমাসবদ্ধ পদ |
---|---|
অন্য্ গ্রাম | গ্রামান্তর |
অন্য্ ভাষা | ভাষান্তর |
অন্য্ রূপ | রূপান্তর |
কেবল হাঁটা | হাঁটাহাঁটি |
কেবল নাম | নামমাত্র |
8. অলোপ সমাস কাকে বলে?
সাধারণভাবে সমাসে পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পায়। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্স নিষ্পন্ন হবার পরেও পূর্বপদের বিভক্তি আগের মতোই থেকে যায়। এই ধরনের সমাসকে অলোপ সমাস বলে। যেমনঃ দুধে ও ভাতে = দুধেভাতে। এই উদাহরনটিতে পূর্বপদের ‘দুধে’ যুক্ত “এ” বিভক্তি সমস্তপদ “দুধেভাতে”- লোপ পায়নি।
অলোপ সমাসের উদাহরণঃ
ব্যাসবাক্য | সমাসবদ্ধ পদ |
---|---|
বনে ও বাদাড়ে | বনবাদাড়ে |
জলে ও কাদায় | জলকাদায় |
মনের মানুষ | মনেরমানুষ |
তেলে ভাজা | তেলেভাজা |
রোদে পোড়া | রোদেপোড়া |
9. বাক্যাশ্রয়ী সমাস কাকে বলে?
বাক্য বা বাক্যাংশে যখন সমাসবদ্ধ পদরূপে ব্যবহৃত হয়, তখন তাকে বাক্যাশ্রয়ী সমাস বলে। বাক্যাশ্রয়ী সমাসে সমাসবদ্ধ পদকে আশ্রয় করে এক-একটি বাক্যের অর্থ প্রকাশিত হয়।
সন্ধি ও সমাসের মধ্যে পার্থক্যঃ
পার্থক্যের বিষয় | সন্ধি | সমাস |
---|---|---|
১. মিলনগত | সন্ধিতে শব্দ জোড়া হয় না, জোড়া হয় একটি শব্দের শেষ ধ্বনির সঙ্গে অন্য্ একটি শব্দের প্রথম ধ্বনিকে। অর্থাৎ সন্ধি হল ধ্বনিগত মিলন। যেমন – বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয় | সমাস হল দুই বা ততোধিক শব্দের অর্থগত মিলন। যেমন – গাছে পাকা = গাছ পাকা। |
২. বিভক্তি লোপ | পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পায় না | বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পূর্বপদের বিভক্তি লুপ্ত হয়। |
৩. অর্থ বজায় | প্রতিটি পদের অর্থ অক্ষুন্ন থাকে। | সমাসে প্রতিটি পদের অর্থ সম্পূর্ণরূপে অক্ষুন্ন নাও থাকতে পারে। |
৪. পদক্রম | সন্ধিতে পদগুলির ক্রম অক্ষুন্ন থাকে। | সমাসে সর্বদাই পদগুলির ক্রম অক্ষুন্ন থাকে না, কখনো-কখনো পদগুলি স্থান পরিবর্তন করে। |
৫. অন্য্ শব্দের ব্যবহার | সন্ধির ক্ষেত্রে কখোনোই সন্ধিবদ্ধ হতে চলেছে এমন কোন একটি শব্দের জায়গায় বাইরের কোনো শব্দ আসে না। | সমাসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাসবদ্ধ হতে চলেছে এমন কোনো একটি শব্দের পরিবর্তে বাইরের কোনো শব্দ আসতে পারে। |